সম্প্রতী একটি জাতীয় দৈনিকের তথ্য মতে ঢাকা শহরে প্রতিদিন ৩৯ টি তালাকের ঘটনা ঘটে। এছাড়াও প্রতিদিন বেড়ে চলছে তালাকের জন্য আবেদন সংখ্যার পরিমান। পরিসংখ্যান দেখলে এটা সুস্পষ্ট যে প্রতিবছর বেড়েই চলছে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা। তালাকের জন্য আবেদন করা এসব নারী পুরুষরা বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আলাদা আলাদা কারন উল্লেখ করেন। পুরুষদের প্রতি নারীদের অভিযোগগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল যৌতুকের কারনে নির্যাতন, পারিবারিক অশান্তি, সন্দেহপ্রবনতা, পুরুষত্বহীনতা, পরকীয়া, নেশাগ্রস্থতা ইত্যাদী। এছাড়া নারীদের ক্ষেত্রে পুরুষদের অভিযোগ হল অবাধ্য হওয়া, ধর্মীয় রীতি মেনে না চলা, পরকীয়া, সন্তান না হওয়া ইত্যাদী। পরিসংখ্যান বলছে গত ৩ বছরে কেবল ঢাকা শহরেই তালাকের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় পাঁচগুন আর বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনাগুলো ৭০% হচ্ছে নারীদের দিক থেকে এবং বাকী ৩০% পুরুষদের দিক থেকে। ঢাকা শহরের পাশাপাশি অন্যান্য শহরের তালাকের সংখ্যা বাড়ছে প্রতিনিয়ত। যা ভবিষ্যতের জন্য এক অশনীসংকেত।
সংসারে বনিবনা না হওয়ায় বিবাহ বিচ্ছেদ না হলেও আলাদা থাকার সংখ্যাটাও কম নয়।। আর বিবাহ বিচ্ছেদ কিংবা আলাদা থাকার কারনগুলোর মধ্যে সবথেকে বড় কারন সন্দেহপ্রবনতা। শহরে কাজের জন্য স্বামী স্ত্রী উভয়কেই হয়তো বের হতে হয়, কর্মক্ষেত্রে অন্যান্যদের সাথে মিশতে হয়, এসমস্ত ক্ষেত্রেও তৈরী হয় সন্দেহপ্রবনতা। এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসহীনতাও হয়ে উঠছে বড় কারন। বিশেষজ্ঞদের মতে এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামীতে বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনা বাড়বে কয়েকগুন। সেক্ষেত্রে সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এসব পরিবারের সন্তানরা। ভেঙ্গে যাওয়া পরিবারের সন্তানরা সাধারনত সামাজিকভাবে অবহেলা আর অনাদরে বড় হয়ে ওঠে। এতো তাদের মধ্যে পরবর্তীতে বিভিন্ন অসামাজিক কর্মকান্ডে লিপ্ত হবার সম্ভাবনা থাকে। বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনায় সামাজিকভাবে পুরুষদের তুলনায় মহিলারা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। এছাড়াও তাদের পরিবারগুলোো সামাজিকভাবে হীনমন্যতার শিকার হয়।
বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন যৌথ পরিবারগুলো ভেঙ্গে যাওয়া বিবাহ বিচ্ছেদের বড় কারন। এছাড়াও সহনশীলতা ও ধৈর্য্যধারন ক্ষমতার অভাব কিংবা সামাজিক অস্থিরতাও বিবাহ বিচ্ছেদের অন্যতম কারন। পূর্ববর্তী যৌথ পরিবারগুলোতে তালাকের ঘটনা ছিল খুবই কম। নিজেদের মধ্যে সমস্যাগুলোতে পরিবারের বয়জোষ্ঠ্যদের অভিজ্ঞতার আলোকে আসতো সহজ সমাধান এছাড়াও যে কারো ভুল হলে পরিবার থেকে যে শাসন করা হত এখনকার একক পরিবারগুলোতে এই সুযোগটা আর থাকছেনা যার কারনে তৈরী হচ্ছে সহনশীলতার অভাব এবং বেপরোয়া জীবন যাপন।
যদিও নিজেদের পছন্দমত মানুষকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেন বেশিরভাগ, এমনকি পরিবারের অনুমিত ব্যতীত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন অনেকেই, কিন্তু সংসার জীবনে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই হয়ে যাচ্ছে বিবাহ বিচ্ছেদ এমন সংখ্যাটা কিন্তু নিছক কম নয়। অনেক সচেতন মানুষই বিবাহবিচ্ছেদের কারন হিসেবে ধর্মীয় অনুভূতির কথা বলেন। প্রতিটি ধর্মেই ছেলে মেয়েদের একসাথে থাকার জন্য বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবার রীতি বিদ্যমান। এক্ষেত্রে বিবাহ পরবর্তী পরনারী কিংবা পরপুরুষের প্রতি আসক্তি কিংবা মেলামেশাকে ইসলাম ধর্মে হারাম করা হয়েছে।
এছাড়াও প্রতিটি ধর্মেই স্বামীর প্রতি স্ত্রী এবং স্ত্রীদের প্রতি স্বামীদের কর্তব্যগুলো বলা আছে। তবে বাস্তবে সেরকমটা হচ্ছে খুব কম। অনেকেই ব্যক্তিস্বাধীনতার দোহাই দিয়ে বেপরোয়া জীবন যাপন করেন যার কারনে পরিবারে তৈরী হয় অশান্তি। যা পরবর্তীতে হয়ে যায় বিবাহ বিচ্ছেদের কারন। কিছুদিন আগে একটি খবর প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রিক মিডিয়ার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ভাইরাল হয় , দেবরের সাথে পরিকীয়া দেখে ফেলার অপরাধে বলি হতে হয় ৫ বছের সন্তানকে! এমন নিউজ এখন যেনো শহরের প্রতিনিয়ত চিত্র। সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে মানুষের নৈতিক অবক্ষয়ের কারনে সমাজে বেড়ে চলছে পরকীয়ার মত ঘৃর্ন্য অপকর্ম। যার কারনে ভেঙ্গে যাচ্ছে সংসারগুলো আর তার বলি হচ্ছে নিরপরাধ সন্তানরা।
বিবাহ বিচ্ছেদের আরেকটি কারন পশ্চিমা সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হতে চাওয়া। আমাদের সংস্কৃতি আর পশ্চিমা সংস্কৃতির মধ্যে আছে বিস্তর ব্যবধান। আমাদের অনেকটা জুড়ে থাকে পরিবারের প্রতি আবেগ আর ভালোবাসা, সেখানে উল্টো চিত্র পশ্চিমা দেশগুলোতে। বর্তমান সমাজে আকাশ সংস্কৃতির কারনে পশ্চিমাদের অনুসরনের প্রভাব লক্ষ্যনীয়। এছাড়াও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতীয় মিডিয়াগুলোর সিরিয়ালগুলোও সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধিতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে। এসব অপসংস্কৃতি আমাদের সমাজে প্রবেশের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি আমরা তৈরী হচ্ছে সামাজিক অবক্ষয়। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা।
বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনাগুলো দুংখজনক, ইসলাম ধর্ম মতে তালাক হচ্ছে সবথেকে নিকৃষ্ট হালাল যার জন্য সৃষ্টিকর্তাও অখুশি হন। তাই বিবাহ বিচ্ছেদের এই সংখ্যা কমিয়ে প্রয়োজন সচেতনতা বৃদ্ধি। মানুষের নৈতিক শিক্ষা পরিবার থেকেই শেখানো হয়, কিন্তু একজন ব্রোকেন ফ্যামিলির সদস্যরা কখনোই সে শিক্ষা পায়না। বিবাহের সময় পারাবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিগুলো মেনে বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া, পরস্পরের প্রতি বিশ্বাসের ভীতকে শক্ত করা, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা রাখা, সকল বিষয়ে সৎ থাকার মানুসিকতা, পরস্পরের প্রতি সহনশীল মনোভাব, পারস্পারিক সহযোগিতা-সহমর্মিতা, নিজেদেরকে সময় দেয়া, সন্তানদের প্রতি যত্নবান হওয়া, আর সামাজিক অস্থিরতা থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব। পৃথিবীর সকল শিশুরা সুন্দর একটা পারিবারিক পরিবেশে বেড়ে উঠুক, সুন্দর হোক সকল সম্পর্ক এই হোক আমাদের প্রার্থণা।